Categories Blog

মনিরার মন খারাপের দিন

মন খারাপ করবার মতো আলাদা কোনো দিনের দেখা এই ২৭ বছর বয়স পর্যন্ত মনিরা পায়নি। আমাদের কাছে যেটা আলাদা করে মন খারাপের, মনিরার কাছে তা প্রতিদিনের অভ্যস্ততা…..

বাবা মায়ের স্মৃতি মনিরার নেই। ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত থেকেছিলো অন্ধ দাদীর সাথে। রেজাল্টের কিছুদিনের মাথায় দাদী মারা গেলো, চাচা ফুপুদের মধ্যে সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা হলো… অথছ মনিরাকে আশ্রয় দেবার দায়িত্বের ভাগ টা কেউ নিলো না! মনিরা অবশ্য এ নিয়ে আফসোস করেনি। স্থানীয় যুব উন্নয়নে টেইলারিং এর প্রশিক্ষন নেয়ার সময়েই এক বড়লোক আপার সাথে তার আলাপ হয়েছিলো। তাই তো চুপিসারে সবাই যখন সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারায় ব্যস্ত, মনিরা তার ৩ টা সালোয়ার কামিজ, ১ জোড়া কানের দুল আর জমানো ৮৯০ টাকা নিয়ে রাজশাহী থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলো। হাত ব্যাগের সাইড পকেটে ছিলো একটা ফ্যাশন হাউজের ঠিকানা।

কমলাপুর ট্রেন থেকে মাঝরাতে নেমেছিলো মনিরা,প্রচন্ড খুদায় মাথা বনবন করছিলো, আশপাশে ঠিকানা দেখাবার কেউন নেই, খুব কাছেই কয়েকটি উষ্কো খুষ্কো চেহারার ছেলে তার দিকে কেমন করে তাকাচ্ছে দেখেও সেদিন মনিরার মন খারাপ হয়নি। বরং নতুন শহর আবিষ্কারের এক অদ্ভুত নেশা পেয়ে বসেছিলো তাকে। বাংলায় একটা প্রবচন আছে, জাতে মাতাল তালে ঠিক! মনিরা ঠিক তেমন ই। রাতটা কাটিয়েছিলো ওয়েটিং রুমেই! প্ল্যাটফর্মের এক গার্ড কে অনুরোধ করে ২০ টি টাকা দিয়েছিলো তার নিরাপত্তার দাম হিসেবে।

পরদিন বিভিন্ন চড়াই উতরাই শেষে লালমাটিয়াতে রুপালী নকশা নামের বুটিক হাউজের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো ১৯ বছর বয়সী মনিরা। তার পর থেকে এখানেই আছে…. প্রথম কিছুদিন কারখানাতেই থাকতো, পরে লালমাটিয়া মহিলা কলেজের মেয়েদের মেসে একটা সিট যোগাড় করে ফেলে সে।

কারখানা থেকে ১০ মিনিটের পথ!

নিজে রান্না করে, কাজ করে,  রাতে মেসের মেয়েদের কাছ থেকে বই নিয়ে হুমায়ুন আহমেদ পড়ে,আবার সিকালে কাজে যায়। মেসের মেয়েরা মনিরাকে একসাথে থাকতে দিলেও কোথায় যেনো তাকে আলাদা করে রাখে। মনিরা টের পায়, কিন্তু তার মন খারাপ হয়না।

জামার বোতাম লাগানো দিয়ে শুরু করে মনিরা এখন রুপালী নকশা ফতাশন হাউজের কাটিং মাস্টার। তার মেজারমেন্ট সেন্স নাকি খুব ভালো, কিন্ত নিজের জীবনের মেজারিমেন্টে কোথায় গন্ডোগল টা হলো তা মনিরা ধরতে পারেনা। এতেও অবশ্য তার মন খারাপ হয়না!

এই মন খারাপ না হওয়া দিনগুলোর কোনো এক সন্ধ্যায় মেসে ফেরার পথে ঝুপ করে বৃষ্টি নেমেছিলো, সাথে ছাতা না থাকার কারনে তার হঠাৎ করেই ভিজতে ইচ্ছে করেছিলো খুব… সোডিয়ামের আলোতে মাথা নিচু করে বৃষ্টি মাখা সন্ধ্যায়  ২৭ বছর বয়সী মনিরার মন তখনো খারাপ হয়নি…. মেস দেখা যাচ্ছে এমন দুরত্বে এসে টের পেলো কেউ একজন তার পাশে এসে ছাতা ধরে আছে। মানুষটা নিজে ভিজছে কিন্তু মনিরাকে ভিজতে দিচ্ছেনা, চোখের কোনে তাকিয়ে মনিরা টের পেলো,নিউ মার্কেটে যার দোকানে সপ্তাহে ১ দিন ম্যাচিং বোতাম লেইস আনতে যায় সে, সেই দোকানের ম্যানেজার মামুন তার পাশে হেঁটে যাচ্ছে… মনিরা দোকানে গেলে মামুন কিথা বলতোনা, বসার টুল এগিয়ে দিতো, স্যাম্পল দেখে নিজে ম্যাচিং করে সব জিনিস বুঝিয়ে দিতো, মনিরার জন্য মাঝে মাঝে চাও আনাতো কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলতোনা!

সেই সোডিয়ামের হলদে আলো মাখা বৃষ্টির সন্ধ্যায় মামুনের পাশাপাশি এক ছাতার নিচে হাঁটতে হাঁটতে মনিরার জীবনের প্রথম বারের জন্য মন খারাপ হয়েছিলো….. শুধু মনে হচ্ছিলো মেস টা এতো কাছে কেন???

Categories Blog

দা কিচেন

অফিস থেকে ফিরেই ঝটপট ব্যাগটা রেখেই কিচেনে ঢুকে যায় তনু! ফ্ল্যাটমেট রিয়া তার পরে বাসায় ফেরে,তাই বেশির ভাগ দিন রান্নার দায়িত্ব তার কাঁধেই পরে। 

অন্যদিনের মতো আজকেও কিচেনে ঢুকে  আগে দেখে নেয় পানি আছে কিনা সিংক এ,  ভাত টা একটা চুলায় বসিয়ে তার পর ফ্রিজ খুলে পটল আর ঝিংগা  বের করে ধুয়ে দ্রুত কেটে ফেলে। পেঁয়াজ মরিচ কাটতে কাটতেই ভাতের বলক চলে আসে।

ভাত টা মাড় ঝড়াতে  বসাতে বসাতেই মনে হয় শিহাবের কথা। বাসায় ফিরে শিহাবকে একটাও ফোন করা হয়নি দেখে নিজের উপড় বিরক্ত হয়ে শোবার ঘরে ফোন নিতে ঢুকতেই কেমন মাথাটা ঘুরিয়ে ওঠে তনুর। ধাতস্থ হয়ে দেখে শিহাব বিছানায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। তনুকে দেখেই জিজ্ঞেস করে ‘তোমার বিরিয়ানি হতে আর কতক্ষন লাগবে? প্রচন্ড খিদে পেয়েছে তনু!!!’ 

তনু কোনো উত্তর না দিয়ে ঘরটাকে দেখতে থাকে,  গতো ৫ বছর ধরে আস্তে আস্তে গড়া তাদের ঘর! এইতো দেয়ালে তার আর শিহাবের বিয়ের ছবি। হুটহাট করে সম্ভবত তার কোনো একটা ট্রমা হয়েছিলো,তাইতো ৫ বছর আগে ফেলে আসা ফ্ল্যাটের স্মৃতি চোখের সামনে চলে এসেছিলো! 

‘আর মাত্র ১০ মিনিট পর খাবার টেবিলে এসো ‘ বলে তনু কিচেনে ফিরে যায়। বিরিয়ানি নামিয়ে সুন্দর ট্রে তে করে খাবার সাজিয়ে টেবিলে রাখে, ফ্রিজ থেকে কোক আনে, গ্লাস নিয়ে কিচেন থেকে বের হতে হতেই আবার সেই মাথা ঘোরা! রিয়ার উচ্ছসিত কন্ঠ শুনে ঘোর ভাংগে তনুর!  রিয়া চিৎকার করে বলছে’ ওয়াও আপু! তুমি বিরিয়ানি রান্না করছো???

জানো আমার আজ দুপুর থেকে বিরিয়ানি খাইতে কি যে ইচ্ছা করতেছিলো!! থ্যাংকিউ আপু!!! ‘ তনু হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, কারন এটা ৫ বছর আগের ঘটনা নাকি সে ৫ বছর পরের সময়ে চলে গিয়েছিলো সে মেলাতে পারেনা!!!

বিরিয়ানির বোল টা খাটের উপর রেখে সে ফোনটা হাতে নেয়, কাঁপা কাঁপা হাতে শিহাব কে কল দেয়। ৩ বার রিং বাজার পর শিহাবের কন্ঠ ভেসে আসে তনুর কানে…. 

দেখো তনু, ৫ বছর আগেই আমাদের সবকিছু শেষ হয়ে গেছে! হুটহাট তোমার এই ধরনের ফোন আমার সাংসারিক জীবনে ঝামেলা করে! তুমি এমন করতে থাকলে আমি তোমার নাম্বার ব্লক করবো! প্লিজ আমাকে আর কল দিওনা!!! ‘ 

ফোন কেটে যায়! তনু দেখে তার পাশে বসে রিয়া পটল আর ঝিংগা  ভাজি দিয়ে ভাত খাচ্ছে আর বলছে

‘আপু তুমি কিচেন থেকে প্লেটটা আনার সময় দেখোতো ফ্রিজে কোকের বোতলটা আছে কিনা? 

প্রচন্ড ঘোর লাগা অবস্থায় তনু কিচেনের দিকে যায়, ফ্রিজ খুলে দেখে ফ্রিজে ব্ল্যাকফরেস্ট কেক এর অর্ধেক… কেকের গায়ের লেখাটা পড়া যাচ্ছে এখনো…